রফিক চৌধুরী একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকুরি করেন।তার ছোট ভাড়াটে বাসায় তিনি একাই থাকেন,বাবা-মা আর ছোট বোন সবাই গ্রামের বাড়।অফিসে থাকাকালীন সময়ে হঠাৎ রফিকের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো।রফিক সাহেবের ছোট বোন রিয়া কল করে,কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলছে,,
---হ্যালো ভাইয়া, বাবা খুব অসুস্থ । বাবাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।বাবার অবস্থা বেশি একটা ভালো না ভাইয়া, তুমি দ্রুত ছুটি নিয়ে চলে আসো।
রফিকের বুকটা ব্যাথায় আজ চিনচিনিয়ে উঠলো,তার প্রিয় মানুষগুলো একে একে সবাই যেন, না ফেরার দেশে পাড়ি দিতে চায়।রফিক সাহেব অফিস থেকে দশদিনের ছুটি নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।রফিকের মনটা আজ বিষন্নতার মেঘে ঢাকা, তার প্রিয় বাবা আজ মৃত্যুশয্যায়।রফিকের মনে অজানা একটা ভয় কাজ করতে লাগলো,পাছে তার প্রিয় বাবাকে হারাতে না হয়!
প্রায় দুইশত পঞ্চাশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে, সোজা হাসপাতালের সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছেন রফিক সাহেব।২১১ নম্বর বেডে বাবাকে এভাবে অসহায়ের মতো শুয়ে থাকতে দেখে,কষ্টে রফিকের বুকটা যেন ফেটে যায়।হঠাৎ রফিকের মনে হলো, তার বুঝি অনেক পোড়া কপাল।তাই হয়তো এক এক করে রফিকের প্রিয় আপনজনেরা সবাই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চাইছে।হাসপাতালের বিছানায় বাবা ঘুমিয়ে আছেন,বিছানার পাশে বসে রফিকের চোখ থেকে অঝরে ঝরছে চোখের নোনাজল।
পাশের বেডে এক অসুস্থ স্বামীকে জড়িয়ে ধরে তার স্ত্রী অঝরে কাঁদছেন।রফিকের দৃষ্টিতে ধরা দিলো,অসুস্থ স্বামীর জন্য স্ত্রীর আর্তনাদ।এমন বেদনাদায়ক দৃশ্য দেখে রফিকের বুকের বাঁমপাশে কয়েক বছরের সেই পরিচিত ঘাঁ ফেঁটে যেন চিন চিনে ব্যাথা অনুভব হলো।এ ব্যাথা যেন হাজার বছরের পুরানো কোন ক্ষতের ব্যাথা,যে ক্ষত হয়তো কখনো শুকাবে না।সামান্য আঘাতে তা আবার কাঁচা ক্ষততে পরিণত হয়।রফিকের মনটা যেন দুই বছর পূর্বের দুর্বিষহ সেই স্মৃতিতে হারিয়ে গেল।
দুই বছর পুর্বের ঘটনা:
রফিক সদ্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। ঢাকায় একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকুরির সুবাদে,দশদিনের ছুটি শেষকরে স্বামী-স্ত্রী দুজনে নতুন ফ্লাটে উঠেছেন।তাদের নতুন সংসারের সবকিছু বেশ মধুরভাবে কাটছিলো।প্রতিদিনের মতো রফিক সাহেব সময়মতো সকালে অফিসে যান, তবে বাসায় ফিরতে তার অনেকটা রাত হয়ে যায়।নতুন বাসায় স্ত্রী নীলাকে একা থাকতে হয়, এজন্য নীলার বড় একা একা লাগে।নতুন জায়গা,অপরিচিত মানুষ,নীলার মনে সব সময় অজানা একটা সংশয় কাজ করতে থাকে।
রফিক অবশ্য নীলাকে বলে রেখেছেন,কেউ কলিংবেল চাপলে দরজা খুলবে না।দরজার সামনে কেউ আসলে, আমাকে আগে কল করে জানাবে।তবুও যেন নীলার মন থেকে সংশয় কাটে না,সব সময় নতুন বাড়িতে একটা ভয় ভয় কাজ করে।যেটা নীলার মনে সব সময় কাঁটার মতো বিঁধে।তবে রফিক নীলাকে প্রতিনিয়ত শান্তনা দিতে থাকে।
পারিবারিকভাবে রফিক-নীলার বিয়ে হলেও অল্প সময়ের ব্যবধানে দুজন দুজনকে অসম্ভব রকমের ভালোবেসে ফেলেছে,এক ঘন্টা কথা না বলে দুজন যেন থাকতেই পারে না।এজন্যই হয়তো অফিস টাইমেও দুজনের প্যাকেজ কথা চলে এক মিনিট,দু'মিনিট,তিন মিনিট।
হঠাৎ একদিন অফিসের মিটিং এর কারনে রফিকের বাসায় ফিরতে একটু বেশি রাত হয়ে গিয়েছে।অবশ্য শহরে রাত দশটা তেমন কোন রাতই নয়,অনেকের কাছে তখনও কেবল যেন সন্ধ্যা মাত্র।নীলার ফোন থেকে পনের বার কল এসেছে।মিটিংয়ের সময় রফিকের মোবাইল ফোন সাইলেন্ট ছিলো,যে কারনে রফিক বুঝতেই পারে নি, নীলা কখন কল করেছে।রফিক কল ব্যাক করল নীলাকে কিন্তু নীলা মোবাইল ফোন রিসিভই করছে না।
রফিক মুচকি হেসে মনে মনে ভাবতে লাগলো,অভিমানে নীলা হয়তো মোবাইল ফোন রিসিভ করছে না।এই বরষায় নীলার প্রিয় কদমফুল হাতে নিয়ে সামনে দাড়ালে,এক নিমিষেই আমার নীলার সমস্ত অভিমান জলে পরিনত হয়ে যাবে।আর বেশি দেরি করা ঠিক হবে না,আমাকে দ্রুত যেতে হবে আমার ভালোবাসার কাঙালিনীর কাছে।
রিক্সা গলির ভিতরে যাবে না, তাই রিক্সাওয়ালা মামা আমাকে মহল্লার মোড়ে নামিয়ে দিলো।আজ সকাল হতে বৃষ্টি হচ্ছে, এখনো রিমঝিম ধারায় বৃষ্টির ফোটা অবিরত পড়ে চলেছে।মহল্লার গলিতে আসতেই কেমন একটা ভূতুড়ে পরিবেশ অনুভব করলাম।বৈদ্যুতিক খুটির মাথায় লাগানো বাতিগুলো আজ সব বন্ধ,চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, একটা গা ছমছমে ভাব বিরাজ করছে।পথে কোন জনমানবের চিহ্ন পর্যন্ত নেই।দুটো অভিভাবকহীন কুকুর আমার পানে চেয়ে বিশ্রী সুরে অভিযোগ করতে লাগলো যেন আমি অনধিকার প্রবেশকারী।
এক হাতে ছাতা,কদমফুল আর অন্য হাতে ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে আমি ফ্লাটের উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করলাম।আধভেজা গায়ে কদমফুল হাতে নিয়ে রোমান্টিক ভঙ্গিতে,নীলার আসার অপেক্ষায় কলিংবেল চেপে দাড়িয়ে রইলাম।
কী ব্যাপার!এখনো নীলা আসছে না কেন? এসে আমার কদমফুল নিচ্ছে না কেন? আসো না নীলা,প্লিজ আসো।আমি দরজায় হাত দিতেই দরজা খুলে গেল।দরজা তো খোলাই ছিল!
নীলা মনে হয় আমাকে প্রথমেই দেখে ফেলেছে, এজন্য অনেক আগেই দরজা খুলে দিয়েছে। নীলা,নীলা, এই নীলা কোথায় তুমি?
আমি ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখলাম, নীলার পছন্দের ফুলদানিটা মেঝেতে পড়ে আছে।কী ব্যাপার নীলার পছন্দের ফুলদানিটা এখানে এভাবে ভেঙে পড়ে আছে কেন?আমি সোজা বেডরুমে চলে গেলাম। আর যেটা দেখলাম সেটা পৃথিবীর অন্য কোন স্বামী সহ্য করতে পারবে কি না সেটা আমি জানি না, তবে আমি পারি নি।
আমার নীলার হাত-মুখ বাধা রক্তাক্ত দেহটা মেঝেতে পড়ে আছে।আমি নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলাম,নীলা নীলা বলে আকাশ বাতাস তোলপাড় করে ডাকতে লাগলাম।কিন্ত আমার নীলা একটি বারের জন্যও আর আমার কথার কোন উত্তর দেয় নি।আমার ডাকে প্রতিবেশীরা সবাই ছুটে এসেছিল কিন্তু আমার নীলা ঘুম থেকে জেগে ওঠেনি,তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।
তিনদিনপর যখন আমার জ্ঞান ফিরে আসলো, নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করলাম, বাবা-মা আর আমার ছোটবোন রিয়া আমার পাশে।আমি নিজেকে কোনভাবে সান্তনা দিতে পারছি না।যে আদরের ছোটবোনকে সব সময় আমি সান্তনা দিয়েছি, সেই পিচ্চি মেয়েটা আজ আমাকে সান্তনা দেবার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে ।আমার জ্ঞান ফিরে এসেছে এ খবর শুনে, থানা থেকে এসআই আলাউদ্দিন সাহেব এসেছেন।
তিনি আমাকে বললেন,,পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হয়েছে আপনি যখন আপনার স্ত্রীর মরদেহ দেখতে পান, তখন থেকে ঠিক প্রায় সাত থেকে আট ঘন্টা পূর্বে মার্ডার করা হয়েছিল আপনার স্ত্রী নীলাকে। মার্ডারের পূর্বে আপনার স্ত্রীকে পাঁচ থেকে ছয়জন ব্যাক্তি ধর্ষণ করেছেন।
-------আহঃ আর বলবেন না প্লিজ,আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
আলাউদ্দিন সাহেব আবারো বললেন,,আপনার অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি রফিক সাহেব, তবুও বাস্তবতাটা আপনাকে মানতে হবে।আপনাকে আরো অনেক শক্ত হতে হবে রফিক সাহেব।আপনার প্রতিবেশীদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
একজন মহিলা বলেছেন,,তিনি বিকাল বেলা জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলার শব্দ শুনেছেন।তবে স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার মনে করে আর তিনি এগিয়ে যান নি।আমরা প্রথমে আপনাকে সন্দেহ করেছিলাম কিন্তু পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এবং স্পটে আমরা কিছু মাদকদ্রব্য পাওয়ায়, এই কেসটাতে আমরা একটা নতুন মোড় খুঁজে পেয়েছি। খুব শীঘ্রই আমরা অপরাধীকে ধরতে সক্ষম হবো ইনশাআল্লাহ।তবে আপনি এটা আমাদেরকে বলুন আপনার কোন বন্ধু কি আপনার বাসায় কখনও এসেছিল?আর আপনি কাউকে কি সন্দেহ করেন?
এসআই আলাউদ্দিন সাহেবের দুইটা প্রশ্নের জবাবেই আমি বললাম জ্বি না।আমার তেমন কোন শত্রু নেই এবং নতুন বাসা নেওয়ায় কেউ আমার বাসায় এখনও পর্যন্ত আসে নি।
আলাউদ্দিন সাহেব বললেন ওকে,আমি আজ চলি। তবে প্রয়োজনে আবার আপনার সাথে সাক্ষাৎ হতে পারে, নিজেকে শক্ত রাখুন।
তবে আলাউদ্দিন সাহেবের আর সাক্ষাতের প্রয়োজন হয় নি।কিছুদিন অতিবাহিত হলে হঠাৎ একদিন জানা গেল, ছয়জন ছেলেকে পুলিশ এরেস্ট করেছে। প্রতিশোধের নেশায় আমি থানায় ছুটে যায় ঐ পিশাচ,কুলাঙ্গার গুলোকে দেখতে,নিজের হাতে তাদেরকে শাস্তি দিতে।জানোয়ারগুলোকে নিজের হাতে হাজারবার শাস্তি দিতে ইচ্ছা করছিলো।হায়েনারা শুধু আমার প্রিয়তমা নীলাকে মারে নি,সাথে নীলার গর্ভের আমার নিষ্পাপ সন্তানকে শেষ করেছে।
জানোয়ারগুলো পাশের বাসার জমির মিয়ার মাদকাসক্ত ছেলে ও তার বন্ধুরা। পুলিশের রিমান্ডের পরে তারা তাদের বয়ানে বলেছে,,দুপুরে রিমিঝিমি বৃষ্টি শুরু হয়েছিলো, আর তাতে আমার নীলা কিছুটা বাঁধন হারা হয়েছিলো। নীল শাড়িতে একা একা ছাদে ভিজতে গিয়েছিল আমার নীলা।আমাদের বাসার পাশেই জমির মিয়ার বিলাসবহুল বাড়ি,ঐ সময় জমির মিয়ার ছেলে ও তার বন্ধুরা নিজের রুমে মাদকদ্রব্য সেবন করছিল।নেশার ঘোরে তারা জানালা দিয়ে আমার নীলাকে ছাদে ভিজতে দেখে।কুলাঙ্গার, হায়েনাদের নজর পড়েছিলো আমার নীলার উপর।তারপর কুকুরেরা আমার বাসায় নীলার উপর হানা দেয়। তারপর আমি আর লিখতে পারছি না আমার নীলার এমন পরিণতির কথা।
বেশকিছু দিন নীলার বিষয়টা খবরের শিরোনাম হয়েছিল। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষেরা দোষারোপ করেছে মাদকদ্রব্য সেবনকারীদের আর যারা মাদক ব্যাবসায়ী তাদেরকে।এতদিন পরে আমার আজও মনে হয় আমার প্রিয় বাংলাদেশে যদি মাদকদ্রব্য নামক শব্দটা না থাকতো তবে হয়তো আমার নীলাকে আজ হারিয়ে যেতে হতো না।শুধু আমার নীলা নয় এমন হাজারো নীলা আছে যারা মাদকসেবীদের অপকর্মের কারনে চিরতরে হারিয়ে যায়।
এই বৃদ্ধ বয়সে বাবা আমাকে নিয়ে অনেক টেনশন করেন সেটা আমি বুঝি।আগামীকাল আমার ছুটির শেষ দিন,আমাকে আবার ঢাকাতে ফিরে যেতে হবে।
আজ মা আমাকে একটি পাত্রী দেখতে যেতে অনুরোধ করলেন,চাচাতো ভাই তুষারের সাথে। কিন্তু মাকে অনেক কষ্টে আমি বুঝিয়ে পাত্রী দেখা প্রত্যাহার করলাম।নীলার ঐ দুর্ঘটনার পর মা প্রতিনিয়ত অনেক পাত্রী দেখেছেন।মা এই দুই বছরে বাইশটার মতো মেয়ে দেখেছেন, আমাকে আবার বিবাহ দেওয়ার জন্য। মাকে বলতে যেয়ে ও বলতে পারি না,আমি যে নীলাকে এখনও অনেক বেশি ভালোবাসি মা।যেদিন নীলার প্রতি আমার এই ভালোবাসাটা আর থাকবে না মা,সেদিন আমি নিজে তোমাকে পাত্রী দেখতে বলবো।
আমি আবারো চললাম আমার নীলার স্মৃতিবিজড়িত ঘরটার উদ্দেশ্যে।আমি না হয় নীলার স্মৃতি আকড়ে ধরেই বাকি জীবনটা পার করে দিবো।
কোন মন্তব্য নেই